বড় ঠাকুরের গোষ্ঠী

বীরেশ্বর ন্যায়াঙ্কার ঠাকুরের জ্যেষ্ঠ পুত্র ও তাঁহার ধারার পরিচয়।
[ইঁহারা বড় ঠাকুরের গোষ্ঠী বলিয়া অভিহিত]

  1. রামগোপাল বিদ্যাবাগীশ

  2. বীরেশ্বরের জ্যেষ্ঠ পুত্র। ভাটপাড়ার প্রথম নৈয়ায়িক। ইনি নবদ্বীপের প্রসিদ্ধ গদাধর ভট্টাচার্য্যের সমসাময়িক কিন্তু বয়ঃকনিষ্ঠ ছিলেন। ন্যায়শাস্ত্রে ইঁহার এমন প্রতিভা হইয়াছিল যে এক সময়ে কুমারহট্টের এক সভায় ইঁহার বিচারপরিপাটী দর্শনে স্বয়ং গদাধরভট্টাচার্য্য সন্তুষ্ট হইয়া বলিয়াছিলেন রামগোপাল বেশ বিদ্যা করিয়াছে। ইনি কর্ম্মবীর ছিলেন আপনার বিদ্যা ও ব্রাহ্মণ্যের বলে প্রায় হাজার ঘর শিষ্য ও ২ হাজার বিঘা ব্রহ্মত্র ভূমি অর্জন করিয়া গিয়াছেন। বাং ১১৬৩ সালে রাজা যাদবরাম চৌধুরীর নিকট হইতে দোরো পরগণায় ৭০০ বিঘা ভূসম্পত্তি প্রাপ্ত\footnote{ভাটপাড়ার বাশিষ্ঠগণ অশুদ্রপ্রতিগ্রাহী কিন্তু ভূপ্রতিগ্রহে শূদ্রাশূদ্র বিচার আবশ্যক হর ন।} হন। ঐ সম্পত্তি রামগোপাল চক্ নামে অভিহিত ও উহা আজও তাঁহার বংশধরেরা ভোগ করিতেছেন। ইনি বড় অল্পায়ু হইয়াছিলেন। ৩৯বর্ষ বয়সেই ইঁহার গঙ্গালাভ হয়।
  3. বিষ্ণুরাম তর্কসিদ্ধান্ত

  4. ইনি রামগোপালের ২য় পুত্র। ইনি ধর্ম্মশাস্ত্রের অধ্যাপক ছিলেন এবং নিজেও বড় ধর্ম্মবিশ্বাসী ও সদাচারী ছিলেন। ইঁহার পাঁচ পুত্র। এই পাঁচ পুত্র হইতেই ইঁহার সন্তানগণ পাঁচবাড়ীর ঠাকুর বলিয়া অভিহিত হইয়া আসিতেছেন। “সর্ব্বতীর্থময়ী গঙ্গা” - এই শাস্ত্রবাক্যে ইঁহার বড়ই শ্রদ্ধা ছিল, তাই তিনি ভাটপাড়ার ভাঙ্গা বাঁধা ঘাটের উপর গঙ্গাগর্ভের শত হস্ত মধ্যে নিজের এক বাস ভবন ও এক শিব মন্দির নির্ম্মাণ করেন। যখন তাঁহার ৫০ বৎসর বয়স, তখন হইতে তিনি বানপ্রস্থের অনুকল্পে গঙ্গাবাস আরম্ভ করেন। সে বাস একেবারে সঙ্কল্পিত ভাবে। ৮৪ বৎসর পর্য্যন্ত জীবিত ছিলেন, ঐ ৩৪ বৎসর একদিনের জন্যও গঙ্গাগৃহ ত্যাগ করিয়া বাড়ী পর্য্যন্ত আসেন নাই। গঙ্গাগৃহে পুরাণেতিহাসের চর্চাতেই কাল কাটাইতেন সন্ধ্যাহ্ণিক দেবপূজা, এ সব তো ছিলই। ইঁহার পূজিত পাষাণময়ী অষ্টভুজা করুণাময়ী নাম্নি মহিষমর্দ্দিনী মূর্ত্তি ও দারুময় সীতারাম বিগ্রহ আজিও ইঁহার বংশধরেরা নিত্য সেবা করিতেছেন। শুনা যার ইঁহার মৃত্যুর পূর্ব্বে ইনি অনেকগুলি দৈব চিহ্ণ লক্ষ্য করিয়াছিলেন। সজ্ঞানে ইষ্ট মন্ত্র জপ করিতে করিতে এই মহাত্মা বিষ্ণুর পরম পদে লীন হন। ইঁহার অধ্যুষিত সেই গঙ্গাগৃহ ও তৎসংলগ্ন শিবমন্দির এখন গঙ্গাগর্ভে বিলীন।
  5. সৃষ্টিধর বিদ্যাপঞ্চানন

  6. বিষ্ণুরামের জ্যেষ্ঠ পুত্র। ইনি একজন বড় ক্রিয়াবান্ ধার্ম্মিক ব্রাহ্মণ ছিলেন। ইঁহার ধারা দৌহিত্রগত হইয়াছে।
  7. পার্ব্বতীচরণ বাচস্পতি

  8. বিষ্ণুরামের মধ্যম পুত্র। ইনিও বড় ক্রিয়াবান্‌ ছিলেন, পৈতৃক সীতারাম বিগ্রহের রাস দোল ও রথ প্রভৃতি উৎসব বড় ধূমধামের সহিত নির্ব্বাহ করিতেন। রথের জাঁক বড় বেশি থাকায় ইঁহার বাড়ী রথের বাড়ী বলিয়া প্রসিদ্ধ।
  9. রামতারণ ঠাকুর

  10. পার্ব্বতীচরণের জ্যেষ্ঠ পুত্র। পিতৃগুণে গুণবান্‌ ছিলেন। পিতার ক্রিয়া কলাপ অব্যাহত রাখিয়াছিলেন।
  11. যদুনাথ ঠাকুর

  12. রামতারণের জ্যেষ্ঠ পুত্র। ঋষিকল্প সুব্রাহ্মণ। ইঁহার বাগ্ব্যবহারে কৃত্রিমত্তা ছিল না। বড় নির্বিরোধী ছিলেন। ইঁহার ক্রোধ কখনও দেখা যায় নাই। বাং ১৩২৫ শালে ৮৫ বর্ষ বয়সে ইঁহার গঙ্গালাভ হয়।
  13. রাধানাথ বিদ্যাবাগীশ

  14. বিষ্ণুরামের তৃতীয় পুত্র। বাকসিদ্ধ মহাপুরুষ ছিলেন বলিয়া শিষ্য সম্প্রদায়ে খ্যাতি ছিল এবং সেই সিদ্ধি বলে বিশেষ সম্মান ও সঙ্গে-সঙ্গে অনেক ভূসম্পত্তি লাভ করিয়াছিলেন। বংশধরেরা এখন তাহা ভোগ করিতেছেন। নিজেও বড় কর্ম্মী ছিলেন মহাভারতাদি পাঠ ও অপরাপর সৎকার্য্যে যথেষ্ট ব্যয় করিতেন।
  15. গুরুপ্রসাদ ঠাকুর

  16. রাধানাথের জ্যেষ্ঠ পুত্র। পিতার উপযুক্ত পুত্র।
  17. কৈলাশচন্দ্র বিদ্যাসাগর

  18. গুরুপ্রসাদের জ্যেষ্ঠ পুত্র। স্মৃতিশাস্ত্রের অধ্যাপক ছিলেন। অনেক ছাত্র পড়াইয়া গিয়াছেন। এখনও ইঁহার বহু ছাত্র জীবিত। ইনি শিষ্যদিগের একজন প্রিয়তম গুরু ছিলেন ইঁহার সদাচার ও বিদ্যাবত্তার বিষয় এখনও শিষ্যমণ্ডলীতে আলোচিত হইয়া থাকে।
  19. অমৃতলাল ঠাকুর

  20. কৈলাশচন্দ্রের জ্যেষ্ঠ পুত্র। স্বভাবেও আকৃতিতে শিবতুল্য ছিলেন। যে যে গুণে ভট্টপল্লীর বশিষ্ঠবংশ বিশিষ্ট সেই সদাশয়তা প্রভৃতি গুণ ইঁহার যথেষ্ঠ পরিমাণে ছিল। বংশের প্রাচীন কীর্ত্তি রক্ষায় ইঁহার আগ্রহ থাকায় এই বংশের মহাপুরুষ বীরেশ্বর ন্যায়ালঙ্কারের প্রতিষ্ঠিত শিবমন্দির দুটির পুনঃসংস্কার কার্য্যে ইনি একজন অন্যতম প্রধান উদ্যোগী হইয়াছিলেন। সংস্কারও ইঁহার যত্নে সুচারুরূপে সম্পন্ন হইয়াছে। বঙ্গের সুসন্তান শ্রীযুত রামদয়াল মজুমদার প্রভৃতি পণ্ডিত ও সাধকগণ ইঁহার মন্ত্র শিষ্য। ইনিও একজন সুকণ্ঠ সাধক ছিলেন। ইঁহার ভগবদ্‌ বিষয়ক সঙ্গীত সকলেরই আনন্দ দায়ক হইত।
  21. নীলমাধব ঠাকুর

  22. গুরুপ্রসাদের কনিষ্ঠ পুত্র। ধার্ম্মিক ও বংশোচিত সদাচারবান্‌ ছিলেন।
  23. নন্দকুমার ন্যায়বাচস্পতি

  24. বিষ্ণুরামের ৪র্থ পুত্র। স্মৃতিশাস্ত্রে বিশেষ ব্যুৎপন্ন ছিলেন ও তাহারই অধ্যাপনা করিতেন। শেষবয়সে পুত্রের উপর সংসারের সমস্ত ভার দিয়া ৺কাশীবাস করেন ও সেই মুক্তিক্ষেত্রেই শিবত্ব প্রাপ্ত হন।
  25. ব্রজনাথ তর্কবাগীশ

  26. নন্দকুমারের জ্যেষ্ঠ পুত্র। ন্যায়শাস্ত্রে পণ্ডিত ছিলেন ও তাহার অধ্যাপনা করিতেন। পিতা কাশীবাসী হইবার সঙ্কল্প করিলে পিতার স্মৃতি শাস্ত্রের ছাত্রগণকেও অধ্যাপনা করাইবেন বলিয়া অল্পকাল মধ্যেই পিতার নিকট স্মৃতি শাস্ত্র আয়ত্ত করিয়া লন। এমন প্রতিভা যে তিনি ন্যায় ও স্মৃতিতে সমান ভাবে সভায় বিচার করিতেন। একাধারে তিনি প্রসিদ্ধ নৈয়ায়িক স্মার্ত্ত অধ্যাপকরূপে বিশেষ গণ্য হইয়াছিলেন।
  27. চন্দ্রনাথ চূড়ামণি

  28. ব্রজনাথের পুত্র। স্বনামধন্য পুরুষ। ইনি এমনিই একজন উদ্যোগী ছিলেন যে মিথিলায় গিয়া ও তথায় দীর্ঘ ৮ বর্ষ কাল থাকিয়া সদগুরুর নিকট জ্যোতিষশাস্ত্র অধ্যয়ন করিয়া আসেন। ইঁহার এক সহাধ্যায়ী ছিলেন, তিনিও এই বংশেরই অন্যতম উজ্জ্বল রত্ন কেদারনাথ সিদ্ধান্তরত্ন। ইনি ফলিত জ্যোতিষে তৎকালে বঙ্গে একজন সুবিখ্যাত ফলী ছিলেন। ইঁহার কোষ্ঠী বিচার ফল হাতে হাতে ফলিত। একটা দৃষ্টান্ত দেওয়া গেল, উলার প্রসিদ্ধ জমিদার বামনদাস মুখোপাধ্যায়ের একমাত্র পুত্র একাদশ বর্ষ বয়সের একটি শিশু পুত্র রাখিয়া অকালে কালগ্রাসে পতিত হয়। বামনদাস ভীত হইয়া চূড়ামণি মহাশয়ের দ্বারা শিশু-পৌত্রটির কোষ্ঠী বিচার করান ও বংশ রক্ষা হইবে কি না জিজ্ঞাসা করেন। চূড়ামণি মহাশয় গণিয়া বলেন যে এই পৌত্রের এই ১১ বৎসর বয়সেই উপনয়নান্তেই বিবাহ দেওয়া হউক, এই পৌত্রের পুত্র হইতেই আপনার বংশ থাকিবে। বামন দাস তাহাই করিলেন। ১১ বৎসরের একটি কন্যার সহিত ছেলেটির বিবাহ হইল। ১১ বৎসরেই কন্যা গর্ভবতী। তাঁহার পর পুত্র প্রসব করার পরই বধূটি বিধবা হয়। যে কথা সেই কাজ, এইরূপে প্রপৌত্র হইতেই বামনদাসের বংশ রক্ষিত হইল। বৈঁচির প্রসিদ্ধ জমিদার রামলাল মুখোপাধ্যায় বাবুও তাঁহার গণনা ফলে চূড়ামণি মহাশয়কে বিশেষ সম্মান করিতেন। ইনি বড় আমুদে ও স্পষ্টবাদী ছিলেন এবং বালকগণকে বড়ই আদর করিতেন।
  29. রামপ্রাণ ঠাকুর

  30. নন্দকুমারের ২য় পুত্র। বংশোচিত নিষ্ঠাবান্‌ ও সাত্বিক ব্রাহ্মণ ছিলেন।
  31. ক্ষেত্রনাথ ঠাকুর

  32. রামপ্রাণের কনিষ্ঠ পুত্র। দেশে বিদেশে নিয়মিত নিত্য প্রাতঃ স্নায়ী শুদ্ধাচার ব্রাহ্মণ ছিলেন। পুত্র পৌত্রেই ইঁহার পুণ্য প্রকাশ পাইয়াছে।
  33. বেণীমাধব ঠাকুর

  34. রামপ্রাণের জ্যেষ্ঠ পুত্র। বংশোচিত সদব্যবহার সম্পন্ন ছিলেন। পুত্রেই ইঁহার পুণ্য প্রকাশ পাইয়াছে।
  35. নবীনচন্দ্র ঠাকুর

  36. ইনি নন্দকুমারের কনিষ্ঠ পুত্র গোবিন্দ ঠাকুরের পুত্র। একজন স্বভাবকবি ছিলেন। ইঁহার রচিত পাঁচালি এক সময়ে জন সমাজে বিশেষ আদর পাইয়াছিল। বড় মিষ্টভাষী ছিলেন। ইঁহার বংশ নাই।
  37. সীতানাথ বিষ্যাভুষণ

  38. ইনি বিষ্ণুরাম তর্কসিদ্ধান্তের ৫ম পুত্র গোপীনাথের একমাত্র পুত্র। ইঁহার পুণ্য পুত্রে কিরূপ প্রকাশ পাইয়াছে নিম্নে তাহা কিঞ্চিৎ লিখিত হইল।
  39. মহামহোপাধ্যায় রাখালদাস ন্যায়রত্ন

  40. ইনি সীতানাথের জ্যেষ্ঠ পুত্র। বশিষ্ঠ বংশের বর্ত্তমান শতাব্দীর চূড়ামণি, ন্যায়শাস্ত্রে দ্বিতীয় গৌতম রাখালদাস ন্যায়রত্ন শুধু বঙ্গের নহে, ভারতের গৌরব। ন্যায়শাস্ত্রে তাঁহার এক অলৌকিক প্রতিভা ছিল এবং সেই অলৌকিকত্ব তাঁহারাই অনুভব করিতে পারিতেন যাঁহারা ন্যায়শাস্ত্রে কৃতী। ন্যায়রত্ন মহাশয় একাধারে দার্শনিক, কবি ও ঋষি ছিলেন। বঙ্গে তাঁহার ছাত্র সংখ্যা অগণিত। মিথিলার তদানীন্তন মহামহোপাধ্যায় বিশ্বনাথ ওঝা প্রভৃতি প্রসিদ্ধ প্রসিদ্ধ পণ্ডিতগণ ন্যায়রত্ন মহাশয়কে “বৃহস্পতি” বলিতেন। তাঁহারই ছাত্র ভাটপাড়ার অন্যতম মহামহোপাধ্যায় শিবচন্দ্র সার্ব্বভৌম বাং ১৩১১ সালে ন্যায়রত্ন মহাশয়ের জীবিত কালেই তাঁহার যে জীবনী লিখিয়া গিয়াছেন তাহা পাঠ করিলে জানিতে পারা যায় ন্যায়শাস্ত্রে ন্যায়রত্নমহাশয় একজন অনন্যপূর্ব্ব ধীমান্ ছিলেন। ১৮৮৭ খ্রিষ্টাব্দে ইনি “মহামহোপাধ্যায়”-এই রাজদত্ত উপাধি লাভ করেন। দার্শনিক রাখালদাস অদ্বৈতবাদখণ্ডন, তত্বসার, জীবতত্বনিরূপণ ও শক্তিবাদরহস্য এই গ্রন্থ চতুষ্টয় প্রণয়ন করিয়া দার্শনিকতার চূড়ান্ত করিয়া গিয়াছেন। কবি রাখালদাস রসরত্ন ও কবিতাবলী নামক গ্রন্থদ্বয়ে কাব্যরসের তরঙ্গ উঠাইয়া গিয়ছেন। ঋষি রাখালদাস বিশ্বেশ্বরের রাজ্যে সুদীর্ঘকাল বাস করিয়া ঋষির মতই বিশ্বনাথের আরাধনা করিয়া গিয়াছেন। কাশীনরেশ গুরুকে যে অর্ঘ্য দান করেন একদিন এই ঋষিকে উহা দান করিয়া আপনাকে ধন্য মনে করিয়াছিলেন। হাতুয়া মহারাজ এই ঋষিকে কাশীবাসী করাইয়া আপনার রাজতাকে সার্থক করিয়া গিয়াছেন। ঋষি বল মুনি বল যোগী বল, কর্ম্মফলের হাত হইতে কেহই এড়াইতে পারে না, তাই ঋষি রাখালদাসকেও শেষ বয়সে একমাত্র পুত্রকে হারাইতে হইয়া ছিল। এ দারুণ কথা লিখিতেও কষ্ট হয়, ঋষি কিন্তু উহা সহ্য করিয়া শিবারাধনায় মনোনিবেশ করিয়াছিলেন। মৃত্যুর পূর্ব্বে স্বীয় ৺কাশীর বাটীতে একটি ৺শিব প্রতিষ্ঠা করিয়া ইনি ইঁহার সমুদয় সম্পত্তি শিবত্র করিয়া গিয়াছেন। বাং ১৩২০ সালে ৮৪ বর্ষ বয়সে সজ্ঞানে মনিকর্ণিকায় ইনি নশ্বর দেহ রাখিয়া গিয়াছেন। কাশীনরেশ ঐ ঋষির নশ্বর দেহের অনন্যসাধারণ সম্মান দেখাইয়া ছিলেন। মণিকর্ণিকার ব্রহ্মনালে উহা দাহ করাইয়াছিলেন। ব্রহ্মনাল কেবল রাজগণেরই দাহস্থান। ইনি একজন সুদীর্ঘাকার সুন্দর পুরুষ ছিলেন।\footnote{ফরিদপুরের কালীকুমার তর্কতীর্থ, দ্বারিকানাথ ন্যায়শাস্ত্রী, বরিশালের ম.ম. বিশ্বেশ্বর তর্করত্ন এনার ছাত্র}
    %\rotatebox[origin=c]{-90}{ \includegraphics[width=12cm]{10689.3589_0335.jpg}
  41. হরকুমার শাস্ত্রী

  42. ইনি রাখালদাসের পুত্র। কবি রাখালদাসের কবি পুত্র। “শঙ্করাচার্য্য” প্রভৃতি কয়েকখানি বাঙ্গালা দৃশ্য কাব্য রচনা করিয়া বঙ্গ সাহিত্যের পুষ্টি করিয়া গিয়াছেন। সংস্কৃতেও ইঁহার কবিত্ব ছিল, “বৃন্দাবনকল্পলতিকা” গ্রন্থ তাহার সাক্ষ্য দিতেছে। এই প্রিয়দর্শন ও প্রিয়ভাষী হরকুমার ফলিত ও গণিত উভয়বিধ জ্যোতিষশাস্ত্রে প্রগাঢ় ব্যুৎপন্ন হইয়াছিলেন। রূপে-গুণে হরকুমার এ বংশের একটি সুগন্ধ ফুটন্ত ফুল ছিলেন, বংশের দুরদৃষ্ট অকালে উহা শুষ্ক হইয়া গিয়াছে। বাং ১৩১৩ সালে শ্রীদক্ষিণাচরণ তর্কনিধি ইঁহার এক জীবনী লিখিয়াছেন।
  43. তারাচরণ তর্করত্ন

  44. সীতানাথের আর এক দিগন্তশুভ্রকারী পুণ্য ফল। ইনি সীতানাথের মধ্যম পুত্র। ন্যায়শাস্ত্রে জ্যেষ্ঠের তুল্যই তেজস্বী। কি অতুলনীয় বাগ্মী! কি গভীর পাণ্ডিত্যের প্রভাব! সকল দর্শনে পারদর্শী অথচ কাব্যালঙ্কারে বিচক্ষণ সে এক a প্রতিভা! কত চম্পূ, খণ্ড কাব্য ও প্রশস্তি রচনা করিয়া প্রাচীন কবিদিগের আসনে স্থান পাইয়াছেন। ইঁহার আকার ও গাম্ভীর্য্য অসাধারণ ছিল। কাশী মহারাজার সভাপণ্ডিত হইয়া কাশীতেই অবস্থান করিতেন। সে কি যে সে সভাপণ্ডিত, তথায় সর্ব্বদেশের মহামহোপাধ্যায় পণ্ডিতগণের মধ্যে তিনি মধ্যমণি! ৺দয়ানন্দ সরস্বতী যখন দিগ্বিজয়ী হইয়া পণ্ডিতগণকে শাস্ত্র বিচারে অপ্রতিভ করিতেছিলেন, তখন একদিন বর্দ্ধমান মহারাজাহূত বিচার সভায় কাশী হইতে এই তারাচরণই আসিয়া বিজয়পতাকা লইয়া বঙ্গের গৌরব বৃদ্ধি করিয়াছিলেন। শুধু বর্দ্ধমানে নহে, চুঁচুড়ায় ৺ভূদেব মুখোপাধ্যায় মহাশয়ের যত্নে ঐ ৺দয়ানন্দ সরস্বতীর সঙ্গে আবার একবার সাকার-নিরাকার বিষয় লইয়া বিচার হয়, তাহাতেও এই তারাচরণই জয়ী হয়েন। দয়ানন্দ নিরাকার সমর্থন করিতে পারেন নাই। ইনি একজন বড়দরের গ্রন্থকার ছিলেন, নিম্নে গ্রন্থের তালিকা দেওয়া গেল: \begin{enumerate} \begin{multicols}{2} \item কানন শতকম্‌ (কাব্য) \item রামজন্ম ভাণম্ (দৃশ্যকাব্য) \item শৃঙ্গাররত্নাকরঃ (অলঙ্কার) \item মুক্তিমীমাংসা (দর্শন) \item বিমলাভাষ্যম (ঈশোপণিষদ্ভাষ্য) \item তর্করত্নাকরঃ (ন্যায়দর্শন) \item খণ্ডনপরিশিষ্টম্ (ন্যায়মতখণ্ডন) \item পরমানুবাদখণ্ডনম্ (ন্যায়মতখণ্ডন) \item সাকারোপসনাবিচারঃ (দর্শন) \item নীতিদীপিকা (নীতিশাস্ত্র) \item কলাতত্বম্ (দর্শন) \item বৈদ্যনাথস্তোতম্ \end{multicols} \end{enumerate}
  45. শশধর ঠাকুর

  46. তারাচরণের জ্যেষ্ঠ পুত্র। ইনি ইংরাজী বিদ্যালাভ করিয়াছিলেন, স্কুল-সাবইন্সপেক্টার হইয়াছিলেন। অকালে ইঁহার দেহ যায়। ইঁহার পুত্রে পুণ্য প্রকাশ পাইয়াছে।
  47. মহেন্দ্রনাথ ঠাকুর

  48. তারাচরণের মধ্যম পুত্র। ইঁহারও অকালে দেহ যায়। ইনিও পুত্রে পুন্যবান।
  49. প্রিয়নাথ তত্বরত্ন

  50. তারাচরণের ৩য় পুত্র। পিতার মত ন্যায় সাঙ্খ্য ও বেদান্ত শাস্ত্রে সুপণ্ডিত ছিলেন। ইঁহার পিতার কাশীলাভের পর কাশী মহারাজ ইঁহাকে সভাপণ্ডিত পদে বসাইয়াছিলেন। যোগ্যতার সহিত সে পদ পালন করিতেন। মৃত্যুর কএক বর্ষ পূর্ব্ব হইতে বর্দ্ধমান মহারাজের সভাপণ্ডিত হন। অল্পদিন হইল ভাটপাড়া এই রত্নকে হারাইয়াছে।
  51. ম.ম. প্রমথনাথ তর্কভূষণ (১৮৬৫-১৯৪৪)

  52. তারাচরণের কনিষ্ঠ পুত্র। \footnote{ঈশ্বরচন্দ্রশাস্ত্রী পঞ্চতীর্থ এনার কৃতী ছাত্র।}
  53. অভয়াচরণ বিদ্যারত্ন

  54. সীতানাথের ৩য় পুত্র। ইনি স্মৃতিশাস্ত্রে প্রধান একজন অধ্যাপক ছিলেন বহু ছাত্রকে অন্ন দিয়া কৃতবিদ্য করিয়া গিয়াছেন। ইঁহার বংশ নাই। সমস্ত সম্পত্তি শিব পরিসেবার জন্য নির্দ্দেশ করতঃ বাস্তুতে এক শিব প্রতিষ্ঠা করিয়া গিয়াছেন।
  55. অন্নদাচরণ তর্কভূষণ

  56. সীতানাথের কনিষ্ঠ পুত্র। ইনি স্মার্ত্ত অধ্যাপক ছিলেন উপরন্তু একজন সুকবি ছিলেন। ইঁহার বিষ্ণুভক্তি উল্লেখযোগ্য ছিল, ইনি যখন শালগ্রামশিলা লইয়া পূজায় বসিতেন, তখন ইঁহার অনবরত বিগলিত প্রেমাশ্রু দর্শনীয় বিষয় ছিল।
  57. জয়রাম ঠাকুর

  58. ইনি রামগোপাল বিদ্যাবাগীশের কনিষ্ঠ পুত্র। পিতার উপযুক্ত পুত্র। ব্রাহ্মণ্যে ও নিষ্ঠায় বংশ উজ্জ্বল করিয়াছিলেন।
  59. রামচন্দ্র বাচস্পতি

  60. ইনি জয়রামের একমাত্র পুত্র। দীপ হইতে দীপের মত ইনিও বংশোজ্বলকারী ছিলেন।
  61. রামকমল ঠাকুর

  62. ইনি রামচন্দ্রের জ্যেষ্ঠ পুত্র। স্বনামধন্য পুরুষ। ইঁহার সম্পত্তি ও শিষ্য সম্পদ্ এত বাড়িয়া উঠিয়াছিল যে তাঁহার ঐশ্বর্য্যগ্রামের সর্বোপরি হইয়া উঠে। সেই অর্থও ইনি নানা প্রকার সদ্ব্যয় করিয়া সার্থক করিতেন। দোল, দূর্গোৎসব, রথ প্রভৃতি তাঁহার ক্রিয়াকলাপ এমন ধূম ধামের সহিত নির্ব্বাহ হইত যে গ্রামে যেন অনবরত একটা পর্ব্ব লাগিয়া থাকিত। তাঁহার এই জাঁকজমকে তিনি রাজা রামকমল বলিয়া অভিহিত হইতেন। তাঁহার পুত্র সন্তান ধারা নাই।
  63. নীলকমল ঠাকুর

  64. ইনি রামচন্দ্রের কনিষ্ঠ পুত্র, জ্যেষ্ঠের মতনই ক্রিয়াশীল থাকায় ইনিও রাজা নীলকমল বলিয়া অভিহিত হইতেন। রথ, দোল, দুর্গোৎসব প্রভৃতি সৎকার্য্য ইনিও বড় ধূমধামের সহিত করিতেন। উৎসবের সময়ে তাঁহার বাটীতে গানের মজলিস্ বসিত ও তাহাতে পশ্চিম দেশীয় বহু গায়ক-গায়িকা আহূত হইতেন। গ্রামে তখন একটা বেশ জমজমা ভাব ছিল, বংশের অনেকেই সঙ্গীতবোদ্ধা থাকায় মজলিস বড় হৃদয়গ্রাহী হইত। ইঁহাদের অন্যতম প্রধান শিষ্য গোবরডাঙার জমীদার সুপ্রসিদ্ধ ৺কালীপ্রসন্ন মুখোপাধ্যায় ও তাঁহার পুত্র ৺সারদাপ্রসন্ন মুখোপাধ্যায় অনেক সময়ে হাতী ঘোড়া সাজ সরঞ্জাম লইয়া গুরুধামে আসিয়া গ্রামের শ্রীবৃদ্ধি ও গুরুবংশের মর্য্যাদা করিতেন। ইঁহারা স্ত্রী-পুরুষে নিজ বাস্তুতে দুটি শিবমন্দির প্রতিষ্ঠা করিয়া গিয়াছেন, মন্দির দুটি অক্ষুণ্ণ অবস্থাতেই আছে, শিবের পূজাও চলিতেছে।
  65. প্রাণকৃষ্ণ ঠাকুর

  66. ইনি নীলকমলের জ্যোষ্ঠ পুত্র। পিতৃমর্য্যাদা অনেকটা রক্ষা করিতে পারিয়াছিলেন। ভাগ্যচক্রের নেমি কিন্তু এই পুরুষ হইতেই উচ্চ হইতে নামিতে আরম্ভ করিয়াছিল। মধ্য বয়সে ইঁহার গঙ্গালাভ হয়।
  67. অতুল কৃষ্ণ ঠাকুর

  68. ইনি নীলকমলের কনিষ্ঠ পুত্র। জ্যেষ্ঠের মৃত্যুর পর ইনিই এ বাড়ীর কর্ত্তা হন। ধর্ম্মপ্রাণ, শান্তস্বভাব, মিষ্টভাষী এই ধীমান্‌ পৈতৃক মর্য্যাদারক্ষার দিকে দৃষ্টি রাখিতেন কিন্তু ঘূর্ণ্যমান ভাগ্যচক্রকে আর থামাইয়া রাখিতে পারেন নাই। অল্পদিনের মধ্যেই ক্ষুন্নমনে স্বর্গধামে চলিয়া গিয়াছেন।